অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম (১৯২১-২০০২) ছিলেন তাঁর কালের বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে, গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে, উপন্যাস নাটক ও ছােটগল্প-লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী ও সম্মানিত। বিভাগীয় প্রধান মুহাম্মদ আবদুল হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে যে গৌরবজনক অবস্থানে উন্নীত করেছিলেন, তাতে অধ্যপক নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী'। তাঁর জন্মস্থান খুলনা জেলায়, তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে পিএইচ ডিগ্রি লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনায় তিনি প্রগতিশীল অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও রােকেয়া হলের প্রভােষ্ট হিসেবে, বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দেশে অবস্থান করে, আত্মক করেন এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। কর্মজীবনে তিনি কাজ করেছেন দেশের বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে। যুদ্ধোত্তর সময়টাতে তিনি বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে এবং যুদ্ধশিশুদের সুব্যবস্থার জন্য কাজ করেছেন। অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের জীবন ছিল কম।
কামাল লােহানী একজন প্রবীণ সাংবাদিক এবং এদেশের গণসংস্কৃতি আন্দোলনের অন্যতম পুরােধা ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। মুক্ত স্বদেশে বাংলাদেশ বেতার সংগঠনের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁরই কাঁধে। কিন্তু টিকতে পারেননি বেশিদিন। একবছর পরে ফিরতে হয়েছিল তাঁর পূর্বের পেশা সাংবাদিকতায়। সহ-সম্পাদক থেকে সম্পাদক হয়েছিলেন সুদীর্ঘকালের এ পেশায়। আবার সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, সাংবাদিক অধিকার ও পেশাগত মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও স্বাধীনতাত্তোর কালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কামাল লােহানী সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, ফ্যাসিবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরােধী সংগ্রামে রাজপথের সৈনিক ছিলেন এবং এখনও আছেন। স্ত্রী দীপ্তি লােহানী (প্রয়াত) ছিলেন গেরিলা যােদ্ধাদের সহযােগী ।
১৯৫০ সালে রংপুর শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।শিক্ষা জীবনের শুরু রংপুর আদর্শ বিদ্যালয় এবং কারমাইকেল কলেজে।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সাইন্স এ মাস্টার্স শেষ করেন।১৯৭৭ সালে তিনি পোলান্ডের ওয়ার্শ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের এন্ড হাইয়ার ম্যানেজমেন্ট এর উপরে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।যুদ্ধের ডাকে সারা দিয়ে মাহবুব আলম ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে ৬ নং সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং সাহসীকতার সাথে যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত যুদ্ধ পরিচালনা করেন।এই পুরোটা সময় তিনি সাথে রেখেছিলেন তিনটি নোট বুক যেখানে প্রতি দিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন।এই নোটবুক গুলোই পরবর্তীতে তার যুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।যুদ্ধ শেষে মাহবুব আলম বিসিএস প্রশাসনে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ২০০৮ সালে যুগ্মসচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।অবসরের পর তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।চাকুরীর সুবাদে দেশবিদেশের বহু জায়গা ঘোরার অভিজ্ঞতা হয় লেখকের।মুক্তিযুদ্ধের লেখায় অবদানের কারনে তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।২০১৪ সালে তিনি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিজয়দিবস উৎযাপনের জন্য কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে অংশ গ্রহণ করেন।তার গল্প নিয়ে "মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর" নামে দেশ টিভিতে একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়।ব্যক্তিগত জীবনে সহধর্মিণী মর্জিনা বেগম (প্রধান শিক্ষিকা) এবং চার কন্যা সন্তানের জনক মাহবুব আলম ঢাকায় নিজ বাসভবনে থাকেন।তার সহযোদ্ধারা এখনো যুদ্ধ দিনের মত তাদের কমান্ডার মাহবুব ভাই এর কাছে কারনে অকারনে প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন।
রফিকুল ইসলাম (১৯৪৩-) চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়া করেন। ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদনা করেন আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান-অ্যান আরবর বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টরে। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বন্দীশিবিরে নির্যাতিত হন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও নজরুল গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। ‘নজরুল নির্দেশিকা’, ‘ভাষাতত্ত্ব’, ‘নজরুল জীবনী’, ‘শহীদ মিনার’, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু কলোকোয়্যেল বেঙ্গালি’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ তিনি আরো অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
কবি শেখ হাফিজুর রহমানের জন্ম টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৫৪-র ৩০শে এপ্রিল। বাবা শেখ হাবিবুর রহমান, মা শেখ সৈয়দা বেগম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে তিনি স্নাতক। স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। আত্মজ হাবিব এই ছদ্মনামে লিখতেন। পরে যখন কবিতাগুলাে গ্রন্থভুক্ত হয় তখন কবি স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেন। ইতােমধ্যে মােট ৬টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত। বাংলাদেশ থেকে নােঙরের তরী ২০০১, মধুমতি ২০০৩, অপরাহ্নের ম্লান আলােয় স্নান ২০১০, দ্রোহের পদাবলী ২০১০। ভারত থেকে গণ পাঁচালি ২০০৭ এবং জার্মানি থেকে জার্মান-বাংলা দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ শেখ হাফিজুর রহমানের নির্বাচিত কবিতা স্বপ্ন ২০১১। প্রথম ধারাবাহিক লেখা ইতিহাস কথা কও' শিরােনামে নিয়মিত প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক খবর পত্রিকায়। পরে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট নামে লেখাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতা চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয়েছে। “রিনি সুতাের মালা’ কবিতাটি অবলম্বনে তথ্যচিত্ররূপে ২০০৮ সালে কলকাতায়। পরিচালনা করেন আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত কলকাতার স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক শ্রীমতী জয়শ্রী ভট্টাচার্য। এই চলচ্চিত্রটি ২০০৯ সালে লন্ডনে রেইনবাে। ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর কবিতাগুলাে বিভিন্ন কাব্যসংকলনেই কেবলমাত্র স্থান পায়নি আবৃত্তিকারদেরও আকৃষ্ট করেছে।
জন্ম : ১৭ এপ্রিল, বরিশাল। হিসাববিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন একটি বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিতে। বীমাশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন ১০ বছর। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশলী সংস্থায় চাকরি করেছেন বছর দুয়েক। গভীর জীবনবোধ তাকে লেখার জগতে নিয়ে আসে। অন্যায়, অসংগতি, দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অপরাজনীতির বিরুদ্ধে এই লেখকের কলম সক্রিয় ও আপোসহীন। একই সঙ্গে তার লেখার মধ্যে এসে পড়ে ইতিহাসের গভীরতর সত্যের আলো। সরস ভাষা, শাণিত বিদ্রুপ, অসাধারণ রসবোধ, নির্ভুল তথ্য আর নির্মোহ বিশ্লেষণের গুণে প্রতিটি লেখাই আমূল নাড়িয়ে দেয় পাঠককে। লিখছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। লেখার ক্ষেত্রে তিনি কখনো এক বিষয়ে আবদ্ধ থাকেননি। ইতিহাস, পরিবেশ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, শিশুতোষ এবং চলমান সমাজ ব্যবস্থাসহ বিচিত্র বিষয়ে তার আগ্রহ। এ পর্যন্ত তার ৩০টি বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, সংকলন, সামাজিক উপন্যাস এবং গল্পগ্রন্থও রয়েছে। গবেষণাধর্মী লেখালেখিতেই তিনি এখন নিমগ্ন। তিনি WALL (Water, Air, Light & Land) Foundation For Safe Living-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি সমাজ গবেষণায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালে সুধিজন সাহিত্য সঙ্ঘ কর্তৃক প্রদত্ত নবাব আবদুল লতিফ পুরস্কার লাভ করেন। প্রবন্ধ, গবেষণা ও কলাম লেখার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি ২০০৯ সালে ‘বাংলাদেশ মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ কর্তৃক প্রদত্ত অধ্যাপক আবুল ফজল পদক লাভ করেন। এর আগে তিনি ২০০৮ সালে সাহিত্য, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিয়াম স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ পুরস্কার লাভ করেন। তিনি তিন কন্যাসন্তানের জনক। ২০০৫ সালে তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করেন।